আসাম বঙ্গ যোগী সম্মিলনী

ভূমিকা

রাজরোষে নাথ ব্রাহ্মণ ও তার সাথে সমস্ত যোগি সম্প্রদায়ের যে সামাজিক বিপর্যয় ঘটেছিল তার থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজে সম্ভবপর হয়নি। এছাড়া ছিল যোগিসম্প্রদায়ের প্রতি উচ্চবর্ণ হিন্দুদের আশালীন ব্যবহার।    সুদীর্ঘ কালের দারিদ্র ও নিরক্ষতা যোগিজাতির উন্নতির পথে ছিল প্রধান  প্রতিবন্ধকতা।  পশ্চিমী রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ও যোগি সম্প্রদায়ের প্রতি অন্যায় সরকারী উদাসীনতা ও সামাজিক অবহেলার ঘটনা  কিছু শিক্ষিত, চিন্তাশীল ও অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিবর্গদের প্রতিবাদী করে তুলেছিল।  নাথ-যোগি সম্প্রদায়ের  ধর্ম, আধ্যাত্মিক সাধন-পদ্ধতি, যোগসাধনা ও আয়ুর্বেদের শিক্ষা, তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্য,  প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রভৃতি প্রাচীন গৌরব সম্পর্কে তাঁরা  উদবুদ্ধ হয়েছিলেন  এবং হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই কাজে যারা অগ্রণী  ছিলেন তাঁরা হলেন আন্দুলের ব্যবসায়ী কৃষ্ণচন্দ্র নাথ দালাল, বর্ধমান-র সমাজ সংস্কারক বিষ্ণুচন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য,  হাতিয়ারা (দমদম) থেকে আগত বেনীয়াপুকুর, কলকাতা নিবাসী মণিমোহন নাথ, বৃটিশ রেল আধিকারিক নাথবন্ধু অরবিন্দ বন্ধু নাথ, শিক্ষাদরদী স্বজাতি বৎসল  নোয়াখালীর আচার্য রাধা গোবিন্দ নাথ ও ভারত চন্দ্র নাথ, ঢাকার উকিল অম্বিকা চরণ নাথ ও বস্ত্রব্যবসায়ী রাম কুমার নাথ প্রভৃতি। আসাম  বঙ্গ  যোগি  সম্মিলনী প্রতিষ্ঠার আড়ালে রয়েছে অনেক ঘটনা প্রবাহ যা নাটকের পট পরিবর্তনের মতো একদিকে যেমন চিত্তাকর্ষক ও রোমাঞ্চকর অন্যদিকে তেমনি বিয়োগাত্মক।

যোগি আন্দোলন

সামাজিক বৈষম্যের প্রতিবাদ স্বারূপ যোগিজাতির উৎকর্ষতা প্রমাণিত হয়েছে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকমণ্ডলী্র প্রশংসাপত্র, পণ্ডিত সমাজে শাস্ত্র-নির্ভর বিচার-বিতর্ক ও পরম হিতাকাংক্ষী বৈদিক পণ্ডিত পরমহংস যোগিরাজদেব প্রতিপালক স্বামী মহারাজের শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এর ফলে কেবলমাত্র উপনয়ন সংস্কার আন্দোলন বা সেন্সাসে যোগিজাতির সঠিক পরিচয় বর্ণনই নয়, তৎকালীন বাংলা ও আসাম জুড়ে যোগিজাতির মধ্যে গণজাগরণ  ও জাতীয় আন্দোলনের সূত্রপাত হল যা পরবর্তিকালে  ‘উপনয়ন-র আন্দোলন‘ হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।  একে একে গঠিত হয় ‘যোগমঠ’, ‘যোগি হিতৈষিণী সভা’ প্রকাশিত হয় ‘যোগশিক্ষা সোপান’, ‘যোগলীলা’, ‘হঠযোগ প্রদীপিকা’  ‘যোগিসংস্কার ব্যবস্থা ও আগম সংহিতা’, ‘বঙ্গীয় যোগিজাতি’ প্রভৃতি। অন্যদিকে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে –  উপনয়ন প্রচারে গিয়ে  সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিত রামকুমার ন্যায়রত্ন ও কৃষ্ণচন্দ্র নাথ দালাল মহাশয়দ্বয় জাতিমাতৃকার চরণে জীবনোৎসর্গ করে অনুপম ত্যাগের দৃষ্টান্ত রেখে যান ।

যোগি হিতৈষিণী সভা

১৯০১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে (বাং ১৩০৭)   ‘যোগি হিতৈষিণী সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়  সমস্যা সংকুল যোগিজাতির সামগ্রিক উত্থানের আগ্রহে।  শিক্ষায় অগ্রগতি, দুঃখ-দৈন্য ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ, যোগি জাতির লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার, উপনয়ন প্রচার, সরকারী উদাসীনতার প্রতিবাদ, সেন্সাসে যোগিজাতির সঠিক পরিচয় বর্ণন, দরিদ্র ছাত্রদের আর্থিক সহায়তা প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছিল সভার প্রাথমিক কাজ।   যোগি হিতৈষিণী সভা-ই  আসাম  বঙ্গ  যোগি  সম্মিলনী-র ভিত্তি  স্বরূপ।

যোগিসখার আত্মপ্রকাশ

অন্যদিকে নাথজাতির দুর্দশায় কাতর অরবিন্দ বন্ধু নাথ অভাবনীয় আত্মবিশ্বাস ও সুদৃঢ় মনোবল নিয়ে স্বজাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বঙ্গ ও আসামের বিভিন্ন জিলার স্বজাতিগণের সাথে সংযোগ স্থাপন কালে তিনি একখানি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। উত্তর ও পুর্ব ভারতের সর্বত্র চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনা ও ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজস্ব মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ করতে থাকেন।

যোগিসখার প্রথম সংস্করণ

অবশেষে ১৩১১ সালের ১লা বৈশাখ   ‘যোগিসখা’ পত্রিকা প্রকাশিত হল, ।  দিনটি যোগিজাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।   ১৩২৫ সালে   নবম  বার্ষিক অধিবেশনে (যার  আহবায়ক ও প্রধান উদ্দোক্তা ছিলেন কর্মবীর অরবিন্দ বন্ধু নাথ)  সম্মিলনীর স্থায়ী সভাপতি অম্বিকা বাবুর বিশেষ উদ্দোগে    ‘যোগিসখা’  সম্মিলনীর মুখপত্র রূপে গৃহীত হয়। পত্রিকাটি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এখনও প্রকাশিত হচ্ছে।

ABYS-র আত্মপ্রকাশ

১৩১৪ সালের ফাল্গুন মাসে (ইং ১৯০৮) ভবানীপুরের কৃষ্ণচন্দ্র নাথ মহাশয়ের বাড়িতে স্বজাতির কল্যাণার্থে এক সভার অধিবেশন হয়। সেখানে আচার্য রাধা গোবিন্দ নাথ বঙ্গ ও আসামের  যোগিজাতির সকলকে সংঘবদ্ধ করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।  অধ্যাপনার কাজে কুমিল্লা গেলেও আচার্যদেব কলকাতার স্বজাতি-বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ অক্ষুন্ন রেখেছিলেন।

ABYS-র উদ্দেশ্য

অতঃপর  কুমিল্লা কলেজের কয়েকজন   স্বজাতি ছাত্রের উৎসাহ ও সহযোগিতায়, স্বজাতিবর্গের পরামর্শ   ও পূর্ব অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে কুমিল্লা তালপুকুরপাড় নাথ ছাত্রাবাসে তিনি এক সভার আহবান করলেন। দিনটি ছিল ৬ই কার্তিক ১৩১৭ সাল (ইং ২৩ শে অক্টোবর, ১৯১০)। ঐ সভায় আসাম ও বাংলার প্রায় পাঁচ শত প্রতিনিধি ও দর্শক যোগদান করেছিলেন। ঐ দিনটি স্বজাতির ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সভায় “আসাম  বঙ্গ  যোগি  সম্মিলনী” –র প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয় ও সভাটিকে সম্মিলনীর প্রথম অধিবেশন রূপে চিহ্নিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে সভা ও সম্মিলনীর সভাপতি পদে  আচার্যদেব মনোনীত হন।

অধ্যবসায় ও প্রসার

সম্মিলনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল  শিক্ষায় আগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জাতির সেবা  ও সমাজ কল্যাণ।  অন্যান্য যে সব কর্মসূচীকে গুরুত্ব দেওয়া হয় সেগুলি  হল যোগিজাতির সঠিক পরিচয় সম্পর্কে স্বজাতিকে জাগরিত করা; নাথ/যোগি ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসার; ধর্মভাবের প্রবর্তন, শৈবধর্ম ও শৈবাচার গ্রহণ; জনসংযোগ বৃদ্ধি; উপনয়ন  সংস্কার; শিক্ষার বিস্তার, উচ্চ-শিক্ষায় উৎসাহ ও ছাত্রবৃত্তি প্রদান; ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা; শিল্প, বানিজ্য ও ব্যবসায়ে আগ্রহ সৃষ্টি; স্থায়ী ধনভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা; বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথার নিবারন; জিলা ও শাখা সমিতি গঠন প্রভৃতি।

উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ

দেশবিভাগ ও পরবর্তী সমস্যাসঙ্কুল ভয়াবহ  পরিস্থিতি সম্মিলনীর আগ্রগতিকে রুদ্ধ করেছে বারবার। তা  সত্ত্বেও সংগঠন আধিকাংশ বাঁধা-বিঘ্ন অতিক্রম করেছে। বিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকে স্থাপিত হয়েছে নিজস্ব ভবন। সকলের সাহায্য ও সহযোগিতা সহযোগে স্বজাতির সেবায় সম্মিলনী কৃতসংকল্প।

বর্তমানের উল্লেখযোগ্য কর্মোদ্যোগ গুলির অন্যতম হলঃ

১)  আচার্য রাধা গোবিন্দ নাথ স্মৃতি দাতব্য চিকিৎসালয় – চক্ষু বিভাগ ও দন্ত বিভাগ।

২) সরস্বতি পাল ছাত্রাবাস – স্বল্প মূল্যে দূরাগত ছাত্রদের থাকার সুব্যবস্থা।

৩) শোভনা চৌধুরী ধর্মশালা – স্বল্প মূল্যে থাকার ঘর ও ডরমিটরী ব্যবস্থা।

8) কৃঁষ্ণ গোবিন্দ শিব স্মৃতি সভাঘর – বিভিন্ন অনুষ্ঠাণ ও সভা-সমিতি আয়োজনের ব্যবস্থা আছে।

৫) যোগিসখা পত্রিকা প্রকাশ ও  প্রতি মাসে সদস্যদের মধ্যে ডাকযোগে বিতরন – যেথায় পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপণ ও বানিজ্যক বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়।

৬) ছাত্র-বৃত্তি প্রদান – প্রতি বছর স্বজাতীয় মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা-বৃত্তি ও অতি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বিশিষ্ট শিক্ষা-বৃত্তি প্রদান করা হয়।

৭) বাৎসরিক অনুষ্ঠাণ সূচী – সম্মিলনীর  বার্ষিক সাধারন অধিবেশন ছাড়াও ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে

পালন করা হয় আচার্য রাধা গোবিন্দ নাথ-র আবির্ভাব দিবস, শিবরাত্রি অনুষ্ঠান ও বিজয়া সম্মেলন।

কাটোয়ায় বিজয়া সম্মিলনী

সম্প্রতি ২০১৯ সালে কাটোয়ায় অনুষ্ঠিত ‘বিজয়া সম্মেলন’ মহা আড়ম্বরে পালিত হয়েছে। তারকা-সমন্বিত ঐ অনুষ্ঠনে দ্বিসহস্রাধিক স্বজাতিবৃন্দ উপস্থিত থেকে দিনভর স্বামী কৈবল্যনাথজী  মহারাজের প্রবচন, বহু শিল্পীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ইন্দ্রজাল প্রদর্শনী, জাতির নেতাদের ভাষণ উপভোগ করেছেন ।

সময়ের সাথে পরিবর্তন - ABYS Website

বিগত ২০১৮ সাল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় অতিবিশিষ্ট  মেধাসম্পন্ন সফল ও  আর্থিকভাবে দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদের “অতিবিশিষ্ট  মেধা বৃত্তি” প্রদান করা হচ্ছে যা বার্ষিক শিক্ষা-বৃত্তি ও  বিশিষ্ট শিক্ষা-বৃত্তি-র  অতিরিক্ত। এ উপলক্ষে বিশিষ্ট শিক্ষা অর্থ-ভাণ্ডারের প্রবর্তন করা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে যা দৃষ্টান্তস্বরূপ।  এছাড়া সম্মিলনীর এ ধরনের কাজে উৎসাহিত হয়ে কিছু স্বজাতিবর্গ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কয়েকজন  ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনার সম্পূর্ণ দায়ীত্ব নিয়েছেন বা সম্মিলনীর শিক্ষা অর্থভাণ্ডারে বিপুল পরিমাণ দান করেছেন। সর্বশেষ উদ্যোগটি হল বহু প্রতীক্ষিত সম্মিলনীর নিজস্ব ‘ WEB SITE’.  যার মাধ্যমে সম্মিলনীকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে আর যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সমস্ত প্রকার কাজে বিশেষ গতি আনা সম্ভব হবে। এই ব্যবস্থাকে সঠিক কার্যকরী করতে সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।