অধ্যাপক গোপাল চন্দ্র দেবনাথ –র স্মৃতিতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি
—- মনি লাল ভৌমিক (সহযোগিতায় সজল কুমার দালাল ও ড. সভাপতি নাথ)
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং আসাম বঙ্গ যোগি সম্মলনীর সভাপতি অধ্যাপক (ড.) গোপাল চন্দ্র দেবনাথ স্বল্প রোগভোগের পর গত ৬ই জুলাই, ২০২২আকস্মিক প্রয়াত হয়েছেন, বয়স হয়েছিল আনুমানিক ৮০ বৎসর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই পুত্র-পুত্রবধূ, বহু আত্মীয়-স্বজন ও গুণমুগ্ধ বন্ধু-বান্ধব রেখে গেছেন।
স্বজাতি হিতৈষী অধ্যাপক দেবনাথের প্রয়াণে আমাদের আসাম বঙ্গ যোগি সম্মলনীর যে অপুরণীয় ক্ষতি হল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তিনি ছিলেন সম্মিলনীর একনিষ্ঠ সেবক ও অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বিগত চার বছর ধরে তিনি ছিলেন সম্মিলনীর মূল স্তম্ভ। ১৭ই জুন, ২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত ১০৮ তম বার্ষিক অধিবেশনে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে কার্যকরী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তিন বছরের জন্য দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর সুষ্ঠ পরিচালনায় সম্মিলনীর কাজকর্মের অগ্রগতি ছিল লক্ষ্যনীয়। গত ২৭ শে ফেব্রুয়ারী, ২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিত সম্মিলনীর ১১১তম বার্ষিক সাধারন অধিবেশনে তিনি পুণরায় তিন বৎসরের জন্য কার্যকরি সমিতি তথা সম্মিলনীর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং গত জুন মাসের মধ্যেই কার্যকরী সমিতির তিনটি সভায় সভাপতিত্ব করেন। গত ২৬শে জুন, ২০২২ তারিখের সভায় অনেক আলোচ্যসুচী থাকায় তাঁকে একটানা পাঁচ ঘন্টা ধরে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নিমগ্ন থাকতে হয়েছিল। কে জানত সেই সভাই হবে তাঁর সম্মিলনীর অন্তিম সভা ।
আধ্যাপক দেবনাথের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশে — কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার অন্তর্গত স্বজাতি অধ্যুসিত ইসলামপুর গ্রামে; জন্ম ৮ই জুলাই, ১৯৪২। পিতা ছিলেন স্বর্গীয় সুর্যকান্ত দেবনাথ ও মাতা স্বর্গীয়া কুমুদিনী দেবী। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশুনা করেন নিজগ্রাম ও পাশের গ্রামের বিদ্যালয়ে পিতৃব্য স্বর্গীয় সুরেশ চন্দ্র দেবনাথ মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে । একবছর পড়েছেন বাঙ্গরা হাইস্কুলে। দেশ ভাগের ফলে তাঁদের পরিবার ত্রিপুরা রাজ্যে চলে আসতে বাধ্য হন এবং আগরতলার শিবনগরে বসবাস করতে থাকেন । তিনি আগরতলার নেতাজী সুভাষ বিদ্যানিকেতন থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও এম.বি.বি. কলেজ থেকে আই.এস.সি. পাশ করেন। পরবর্তীকালে অভিভাবকদের ইচ্ছানুযায়ী ইঞ্জিনীয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট এবং সর্বোপরি চাকুরীর তাগিদে তাঁকে ত্রিপুরা রাজ্যের বাইরে আসতে হয়। তিনি গৌহাটীস্থিত আসাম ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ থেকে বি.ই.. ও পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ইন সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং (MCE) পাশ করেন স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়ে। কয়েক বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী ।
চাকুরী জীবনের প্রথম দিকে তিনি আসাম ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ, গৌহাটী ও শিলচর রিজিওনাল ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে (বর্তমান National Institute of Technology) প্রায় সতের বছর অধ্যাপনার কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৩ সালের ৭ই জুন অধ্যাপক দেবনাথ পশ্চিম বঙ্গ সরকারের কারিগরী শিক্ষা দপ্তরে (Dept. of Technical Education) যোগদান করেন। কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর পদোন্নতি হয় – প্রথমে Joint Director, পরে Additional Director পদে। অবশেষে ১৯৯৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কারিগরি শিক্ষা অধিকর্তা অর্থাৎ Director, Technical Education Govt., of West Bengal পদে উন্নীত হন। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় জ্যোতি বসু মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত । ড. দেবনাথ তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা গোটা পশ্চিমবঙ্গের পলিটেকনিক ও ডিগ্রী ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নয়নের দিকে বিশেষ মনোনিবেশ করেন এবং এই সব কলেজগুলির পরিচালন বিভাগগুলিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে একনিষ্ঠ কর্মী ও পরিচালকরূপে অবতীর্ণ হন। অধ্যাপক দেবনাথ ২০০২ সালে অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত সগৌরবে উক্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গে মাত্র চারটি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ছিল ১৯৯৫ সালের পূর্বে – যাদবপুর, শিবপুর, উত্তরবঙ্গ ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ ও রিজিওনাল ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ, দুর্গাপুর। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার মাধ্যমে মাত্র ১২০০ ছাত্র-ছাত্রী ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার সুযোগ পেতো। সীমিত আসন সংখ্যার জন্য রাজ্যের ছেলে-মেয়েদের দক্ষিণ ভারতে বিশেষ করে কর্নাটকে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে যেতে হত । দক্ষিণ ভারতে শত শত প্রাইভেট ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ থাকায় পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রচুর খরচ করে সেখানে পাড়ি জমাতো ও পাশ করার পর দেশে বিদেশে চাকরী করার সুযোগ পেতো। শিক্ষা অধিকর্তা থাকাকালীন ড. দেবনাথ-র ভাবনায় পশ্চিমবঙ্গে অনুরূপ প্রাইভেট ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ স্থাপনের প্রচেষ্টা শুরু হলো যাতে এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক সংকুলানের মধ্যে অনুরূপ পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়। এরপর উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর সহমতে, বিভিন্ন শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় এবং all india Council forTechnical Education (AICTE), Govt. of India –র অনুমোদনক্রমে শুরু হলো ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ স্থাপনের বেসরকারী উদ্যোগ। একে একে স্থাপিত হলো – Institute of Engineering & Management, Kolkata, Netaji Subhash Engineering College, Kolkata, Heritage Institute of Technology (Techno India), Kolkata, Dr BC Roy Engineering College, Durgapur, Haldia institute of Technology, Haldia, Bankura Unnayani Institute of Engineering, Bankura, Asansol Engineering college, Asansol। তিনি তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৩৬ টি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে কারিগরী শিক্ষার পরবর্তী অগ্রগতি এখন এতিহাস। পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারী উদ্যোগে একের পর এক ডিগ্রী ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় যার বর্তমান সংখ্যা সরকারী ও বেসরকারী মিলিয়ে ১২০ টিরও বেশী। ফলে পশ্চিমবঙ্গের ছেলে-মেয়েদের ডিগ্রী ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার স্বপ্ন সার্থক হয়। এই উদ্যোগের ফলে একই ধারায় পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ্য ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ বা পলিটেকনিক। বর্তমানে লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রী এই পাঠ্যক্রম বেছে নিচ্ছে শুধুমাত্র এই রাজ্য থেকেই নয় – পূর্ব এবং উ. পূর্ব ভারতের সমস্ত রাজ্য থেকে। অবসর গ্রহণের পর অধ্যাপক দেবনাথ বেশ কয়েকটি কলেজের বোর্ড অফ গভর্নরস –এর ‘চেয়ারম্যান’ পদ অলংকৃত করেন এবং কলেজগুলির উন্নয়নে যথাযথ সহায়কের ভুমকা পালন করেছেন। ড. দেবনাথ মহাশয়কে পশ্চিমবঙ্গের ইঞ্জিনীয়ারিং শিক্ষার আগ্রদূত বললে অত্যুক্তি হয় না।
তিনি ছিলেন All India Council forTechnical Education (AICTE) –র পরিচালক সমিতির সদস্য। প্রতিষ্ঠা কাল থেকে West Bengal University of Technology-র আহ্বায়ক (convener)। তেমনি অনেক কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন পরিচালক সমিতির সভাপতি, উপদেষ্টা বা সদস্যরূপে। এছাড়া ছিলেন Institute of Civil Engineers এবং Geological Society of India-র মতো সংস্থার ফেলো।
অধ্যাপক দেবনাথ যে জেলায় জন্মেছিলেন তার প্রকৃত নাম ছিল ত্রিপুরা, তদানিন্তন চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত – জনমানসে যা ‘সমতল ত্রিপুরা’ নামে খ্যাত ছিল। ভৌগলিক কুমিল্লা ছিল জেলার একটি মহকুমা আর কুমিল্লা শহরটি ছিল ত্রিপুরার জেলা সদর। দেশ ভাগের পর পাকিস্তান সরকার কুমিল্লাকে আলাদা জেলা হিসাবে চিহ্নিত করে। বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যের ( রাজধানী আগরতলা ) পূর্বতন নাম ছিল ‘পার্বত্য ত্রিপুরা’ এবং সেটি ছিল বৃটিশ শাসন মুক্ত একটি স্বাধীন রাজতান্ত্রিক দেশ । ত্রিপুরা মহারাজাদের শাসিত পার্বত্য ত্রিপুরার রাজভাষা বরাবরই ছিল বাংলা। প্রয়াত দেবনাথ ছিলেন উভয় ত্রিপুরার অনুরাগী। জন্মেছিলেন সমতল ত্রিপুরায় কিন্তু দেশ বিভাগের পর কুমিল্লা বা সমতল ত্রিপুরা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের শত সহস্র হিন্দু উদ্বাস্তুদের মতো তাঁর পরিবারও ত্রিপুরা রাজ্যে চলে আসতে বাধ্য হন। তাই তিনি উভয় ত্রিপুরার জনগণের সাথে আত্মীয়তা অনুভব করতেন এবং অন্যান্য ছিন্নমুল বাঙ্গালীদের মতো তাঁদের সার্বিক উন্নতি বিধানে সচেষ্ট থাকতেন। এই উদ্দেশ্যেই কলকাতার ৩ নং সূর্যসেন ষ্ট্রীটে অবস্থিত এবং জনকল্যানে নিয়োজিত ‘ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভা’-র বিশিষ্ট আজীবন সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে ত্রিপুরা জেলার কিছু মনিষীদের উদ্যোগে এই প্রতিষ্ঠানটি ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা শহরে পরে স্থানান্তরিত হয় কলকাতায়।পরবর্তীকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে ত্রিপুরার মহারাজাও এতে সামিল হন। অধ্যাপক দেবনাথ ২০০৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী কলকাতার স্টুডেন্টস হলে ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বার্ষিক প্রীতি সম্মেলনে সভাপতির আসন অলংকৃত করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ২৯ শে মার্চ, ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত আসাম বঙ্গ যোগি সম্মিলনীর ৯৯তম বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে তিনি অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। অধিবেশনের স্বাগত ভাষণে তিনি যে হৃদয়গ্রাহী ও অনুপ্রেরণামুলক বক্তব্য রাখেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তিনি কারিগরি শিক্ষার অধিকর্তা থাকাকালীন ত্রিপুরায় কারিগরি শিক্ষার প্রসারকল্পে সেখানকার উচ্চশিক্ষা অধিকর্তাকে যেসব সুদূরপ্রসারী ও বাস্তব সম্মত পরামর্শ দিয়েছিলেন সভায় তিনি তার উল্লেখ করেন। যার ফলশ্রুতি ত্রিপুরা রাজ্যে বর্তমানের National Institute of Technology (NIT) Agartala এবং Indian Institute of Information Technology (IIIT)। তাঁর সাথে আত্মীয়তা ও সাংগঠনিকভাবে যুক্ত থাকায় তাঁর প্রয়াণে আমরা গভীরভাবে শোকার্ত এবং এ ক্ষতি অপরিসীম। তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে ---
“তোমার পায়ের পাতা
সবখানেতে পাতা
কোনখানেতে প্রণাম আমার রাখি”
তাঁর বাহ্য কায়ার অবসান হলেও তাঁর চিন্ময় প্রাণের মৃত্যু নেই। তাঁর ত্যাগ, সাধনা ও জ্ঞানচর্চার অগ্নিকণা সর্বত্র সঞ্চারিত হয়ে আমাদের সকলকে তাঁর আদর্শে উদবুদ্ধ ও সচেষ্ট করুক--- ইহাই শিব-মহেশ্বর সমীপে বিনীত প্রার্থনা। পরিশেষে প্রয়াত অধ্যাপক ড. গোপাল চন্দ্র দেবনাথের বিদেহী আত্মার পরম শান্তি কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।
ব্যক্তিগত ভাবে ও যথার্থ অর্থে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। তাঁর মননে ছিল দেশে শিক্ষায় সর্বাধিক বিকাশ ঘটানো। সম্মিলনীর দায়ীত্ত্বেও ছিলেন সদা জাগ্রত। স্বজাতি ও সম্মিলনীর উৎকর্ষে সর্বপ্রকার জনহিতকর কাজে তাঁর বিশেষ উৎসাহ ছিল। সম্মিলনীর কার্য পরিচালনায় তিনি দক্ষ প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেছেন। প্রমাণ রেখেছেন তাঁর অনন্য ব্যক্তিত্বের। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে আমরা মর্মাহত, বিমূঢ় ও শোকস্তব্ধ। তাঁর প্রতি আমরা আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই আর প্রার্থনা করি তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করে।
।।ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।
০০০০০০০