‘ স্মরণে মননে অধ্যাপক (ড.) গোপাল চন্দ্র দেবনাথ ’
মৈত্রী সংস্থার নিবেদনে শ্রদ্ধাঞ্জলী
রচনা, নির্দেশনা, ধারাভাষ্য ও পরিচালনা : শ্রীমতী মৈত্রেয়ী চৌধুরী
[ পরিচালক – মৈত্রী সংস্থা এবং আহ্বায়ক, সাংস্কৃতিক উপসমিতি, আসাম বঙ্গ যোগি সম্মিলনী ]
অধ্যাপক ড. গোপাল চন্দ্র দেবনাথ – এমন একজন গুণী পণ্ডিতের জন্য শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। বরাবর মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ড. দেবনাথ পশ্চিমবঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা বিস্তারে অগ্রদূত রূপে স্মরণীয হয়ে থাকবেন। তিনি ছিলেন যথার্থ শিক্ষাবিদ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি – সকলকে সর্বদা সৎ পরামর্শ দিতেন। পারিবারিক জীবন তাঁর কাছে ছিল প্রশান্তির দর্শন রূপে। তাঁর জীবনে সহধর্মিনী শ্রীমতী কল্পনা দেবনাথ যথার্থ গুণী ও উৎসাহ প্রদায়িকা শক্তি।
সকলের সাথে নিরহঙ্কারী ড. দেবনাথের সম্পর্ক ছিল সুমধুর। প্রায় ৪ বৎসরের বেশি সময় ধরে তিনি আসাম বঙ্গ যোগি সম্মিলনীর সভাপতির পদ অলংকৃত করেছেন সুচারু ও দক্ষতার সাথে। বিগত ৬ই জুলাই, ২০২২ শ্রাবণ মেঘের ধারার সাথে অধ্যাপক দেবনাথ ৭৯ বৎসর বয়সে আমাদের সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে অমৃত লোকে চলে গেলেন। আমরা সকলে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। তাঁর পরিবার পরিজনের সাথে আমাদের ও রেখে গেলেন বিষাদগ্রস্ত বলয়ে ।
‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে, সেদিন ভরা সাঁঝে,
যেতে যেতে দুয়ার হতে কী ভেবে ফিরালে মুখ খানি ——
কী কথা ছিল যে মনে ।।
তুমি সে কি হেসে গেলে আঁখিকোণে ——
আমি বসে বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি,
তুমি আছ দূর ভুবনে …….’
‘শ্রীমদ ভগবদ গীতা’-র সাংখ্য যোগে ভগবান অর্জুনকে বলেছিলেন ——
‘বাল্যকাল গিয়া আসে যেমন যৌবন,
যৌবনের পরে আসে বার্দ্ধক্য যেমন
সেরূপ অবস্থা ভেদ মরণে কেবল
তাহে নাহি মুগ্ধ হন পন্ডিত সকল ।।
সুখ দুঃখ আসে সত্য থাকে না আবার
তাই সুখ দুঃখ বোধ অনিত্য অসার,
নিত্য জন্মে মরে আত্মা মনে যদি হয়
তথাপি করিতে শোক পার না নিশ্চয় ।।
‘আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো ।
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে ——
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত ।
সে চলে গেল, বলে গেল না —— সে কোথায় গেল ফিরে এল না ।
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল কী যেন গেয়ে গেল ——
তাই আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে ।…..’
নিত্য দিনের, দিন যাপনের মাঝে হঠাৎই মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়, মৃত্যুকে যে জীবনে প্রথম প্রত্যক্ষ করেছে —— তার কাছে মৃত্যু এক প্রহেলিকা —— মৃত্যু তার কাছে বিস্ময়। …..সাজানো ঘর, সংসার, স্ত্রী, পুত্র সবাইকে অন্ধকারে রেখে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বিলীন হয়ে যায় …….।
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু সম্বন্ধে বলেছেন …”মৃত্যু আপনজনকে নিঃসঙ্গ করে চলে যায়। নীলাকাশ, ছেলেবেলা, হলুদ শস্য, রামধনু রঙ —— সবই এপারের —- ওপারে শুধু শূণ্যতা।“
‘আছে দু;খ, আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে ।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ।।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ……..
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ ——
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে ।।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর ও বলেছেন , “চারিদিকের গাছপালা, মাটি, জল, চন্দ্র, সূর্য্, তারা —— সবই সত্য। সেই সত্যের মাঝখানে যাহাকে তাহাদের সকলের চেয়ে বেশী সত্য করিয়াই অনুভব করিতাম —— সেই নিকটের মানুষ যখন এত সহজে, এক নিমেষে স্বপ্নের মতো মিলাইয়া গেল তখন সমস্ত জগতের দিকে চাহিয়া মনে হইতে লাগিল – একি অদ্ভুত আত্ম খণ্ডণ। মৃত্যু যখন মনের চারিদিকেহঠাৎ ‘নাই’ অন্ধকারের সীমা গড়িয়া দিল তখন মনপ্রাণ অহোরাত্র দু;সাধ্য চেষ্টায় ‘আছে’ বলিয়া সান্তনা খুঁজিতে লাগিল।“
‘দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে ।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে ।।……
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিন পুরে ।।‘
জীবন যেমন সত্য – মৃত্যুও তেমনি সত্য। মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায় ?
আমরা বিশ্বাস করি আত্মা অমর – আমরা বিশ্বাস করি জন্মান্তরের, ‘জন্ম-মৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের রঙ্গমঞ্চের খেলা’। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবন রূপান্তর লাভ করে, বাসা বদল করে – এক ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে যায়। এটাই চির সত্য।
‘ জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে … ।।
গীতায় বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে ভগবান বলেছেন –
“ জীর্ন বাস ছাড়ি যথা মানব নিশ্চয়,
নববস্ত্র পরিধান করে ধনঞ্জয়
সেই রূপ জীর্ণ দেহ করি পরিহার
নব কলবরে আত্মা ধরে পুনঃ বার ।“
আত্মা অমর। মৃত্যু জীর্ণ জীবনের খোলস বদল করে নতুন রূপ ধরে আসে মর্ত্তে। জীবন ও মৃত্যু মিলে জীবন প্রবাহ। ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে’।
রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে বলেছেন – “যার সংগে আমার সামান্য পরিচয় আছে সে আমার পাশে থাকলেও তার আর আমার মাঝখানে একটি সমুদ্র পড়ে থাকে – সেটি হচ্ছে অচৈতন্যের সমুদ্র, ঔদাসীন্যের সমুদ্র।“
“এবার আমায় ডাকলে দূরে
সাগর-পারের গোপন পুরে ।।
বোঝা আমার নামিয়েছি যে, সঙ্গে আমায় নাও গো নিজে,
স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুদ্ধা পান করাবে তৃষ্ণাতুরে ।। …..
তারার আলোয় প্রদীপখানি প্রাণে আমার জ্বালবে আনি,
আমার যত কথা ছিল ভেসে যাবে তোমার সুরে ।।“
ঋষি অরবিন্দ তাঁর পুনর্জন্ম গ্রন্থে বলেছেন – “মৃত্যুর পর আত্মার তিনটি স্তরের কথা – (১)অনুময়, (২)মনোময় ও সবশেষে (৩)চৈত্য পুরুষ বা মহাপুরুষ। জীবনের কর্মফলের উপর নির্ভর করে আত্মার পুনর্জন্ম। গীতায় বলা হয়েছে – পূণ্যবান ব্যক্তি মর্তে ফিরে আসেন না। কোন কোন ব্যক্তি মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্য মনোময় স্তরে অবস্থান করেন – তারপর মুক্ত আকাশে বিলিন হয়ে যান। তখন তিনি শুধু ছবি হয়ে থাকেন —“
‘ তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা । …….’
একদিন আমি চলে যাব – পরে, থাকবে আমার সব – আমার স্মৃতি।
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে, ……”
আলো থকলে অন্ধকার থাকবে। জন্ম থাকলে মৃত্যু থাকবেই। মৃত্যু না থাকলে জরাজীর্ণ দেহ নিয়ে জীবন-যাপন দুর্বিসহ – তাই মৃত্যুর প্রয়োজন।
“ দীর্ঘ জীবনপথ, কত দুঃখতাপ, কত শোকদহন ——
গেয়ে চলি তবু তাঁর করুণার গান ।।……
শ্রান্তি ঘুচিবে, অশ্রু মুছিবে, এ পথের হবে অবসান ।।…… “
রবীন্দ্রনাথের ‘হতভাগ্যের গান’-র কথায় –
“মৃত্যু যেদিন বলবে —— ‘জাগো,
প্রভাত হ’ল তোমার রাতি
নিবিয়ে যাব আমার ঘরের
চন্দ্র সূর্য দুটো বাতি ।…..”
ভারতবর্ষ চিরকাল মৃত্যুর মাধ্যমে অ-মৃতের সন্ধান করেছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে পাই
‘ওঁ অসতো মা সদ্গময় ।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।।
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।…….’
অর্থাৎ
আমাকে অসত্য হইতে সত্যে লইয়া যাও,
অন্ধকার হইতে আলোকে লইয়া যাও এবং
মৃত্যু হইতে অমৃতে লইয়া যাও ।।…….
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ।।
“জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো ।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো ।। …..
হৃদয় প্রান্তে, হে জীবননাথ, শান্ত চরণে এসো …।।‘
মৃত্যু এসে, শক্ত হাতে, নির্মমভাবে প্রিয়জনকে নিয় যায় – তবু অশ্রুভরা মিনতিকন্ঠে আবেদন –
“চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না ।……”
আমাদের অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস স্বর্গীয় অধ্যাপক ড. গোপাল চন্দ্র দেবনাথের বিদেহী আত্মা আঁধারের ওপারে অ-মৃ-ত লোকে যে আদিত্যবর্ণ পরম পুরুষ আছেন তার কাছে ইতিমধ্যেই পৌঁছে যাবেন। শান্তিতে বিরাজ করবেন সেখানে ——
আমাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে মুক্ত নভোমণ্ডলে বিচরণ করছেন তিনি। তাঁর এই যাত্রাপথে আমাদের মৈত্রী সংস্থা ও সম্মিলনীর অন্তরের শুভেচ্ছা জানিয়ে স্বর্গীয় অধ্যাপক (ড.) গোপাল চন্দ্র দেবনাথ মহাশয়ের “স্মরণে মননে শ্রদ্ধাঞ্জলী” সমাপ্ত করলাম।
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ।।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০